সাদা পর্দার ফাঁক গলে সকালের নরম রোদ এসে পড়ল অর্পার চোখে-মুখে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো তার। হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠে বসল!
"ইশ! দেরি হয়ে গেল! সবসময় আমারই কেন এমন হয়? এতক্ষণে ওরা হয়তো পৌঁছে গেছে..."
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল।
— "হ্যালো! হ্যালো! হ্যাঁ, এই তো... আর ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি!"
ওপাশ থেকে বিরক্ত কণ্ঠ ভেসে এল—
— "৫ মিনিট? তোর ৫ মিনিট মানে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা!"
— "আজকেই শেষবার! এরপর থেকে তোদের আগেই আমি আসব!"
ঠিক ৪৫ মিনিট পর, যথারীতি দেরি করেই গন্তব্যে পৌঁছাল অর্পা।
লোপা ছুটে এসে চিৎকার করে উঠল, "এই তো এলি! সকাল থেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! কতদিন ধরে বইমেলায় যাবো বলে প্ল্যান করছি, আর তুই— তোর কোনো হদিসই নেই!"
— "খবর আছে বলেই তো এলাম! এখন কথা বন্ধ করে চল!"
অবশেষে চার বন্ধু— অর্পা, পলাশ, লোপা ও তুহিন— বইমেলার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
বইমেলার ভিড়ে এক অচেনা চেনা মুখ
অর্পা আগেও বইমেলায় এসেছে, কিন্তু বই পড়ার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ নেই। অন্যদিকে, লোপার এটাই প্রথম বইমেলায় আসা। প্রতিটি স্টলে দাঁড়িয়ে বই দেখছে সে, যেন নতুন কোনো দুনিয়ায় প্রবেশ করেছে। পলাশ আজ উদাসীন— বইমেলায় তার মন নেই, আর তুহিন ব্যস্ত ফোনে।
হঠাৎ, ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে নজর গেল অর্পার। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো মেয়েটাকে সে চেনে! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। লোপাকে বলতে গিয়েও বলল না, কারণ সে বই নিয়ে এতটাই মগ্ন যে ওর কাছে যাওয়ার উপায় নেই। তাই একাই এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে...
কাছে গিয়ে আরও ভালো করে তাকাতেই বুক ধক করে উঠল! মেয়েটার মুখ তার খুব চেনা লাগছে! মনে করার চেষ্টা করতেই শরীর অবশ হয়ে এলো, মনে হলো— এখনই পড়ে যাবে!
আনমনে বলে উঠল—
"এই মেয়েকে আমি চিনতে পারছি... গলার দাগটা ভুলতে পারি কী করে? এত কাছের একজনকে কীভাবে ভুলে গেলাম!"
পলাশের ডাকে চমকে উঠল অর্পা।
— "এই তুই এখানে কী করছিস? আমরা কতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোকে!"
— "না... মানে... এমনি এসেছিলাম..."
অর্পা ওর বন্ধুদের কথা শুনে মেয়েটি প্রথমবারের মতো এদিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতর কেমন জানি একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল অর্পার শরীরে।
তুহিন: "তোর কী হয়েছে, অর্পা? তুই ঠিক আছিস তো?"
অর্পা কোনো উত্তর দিল না।
দীর্ঘ ১২ বছর পর খুব প্রিয় একজনকে দেখল সে— তার শৈশবের একমাত্র সত্যিকারের বন্ধু!
সেই বন্ধু, যার হাত ধরে সে একসময় হেঁটে বেড়াত, গল্প করত, একসঙ্গে খেলত, ঝগড়া করত, মান-অভিমান করত... এত ভালোবাসার একজনকে কীভাবে ভুলে গেল এতগুলো বছর!
"কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে বিজ্ঞাপন দিতে হয়, তুই বুঝি তা জানিস না?"
সেই চেনা কণ্ঠস্বর... সেই পরিচিত হাসি...
অর্পা পাশ ফিরেই দেখল, মেয়েটি তার একদম কাছেই দাঁড়িয়ে আছে!
মেয়েটির নাম নন্দিতা।
অর্পার শৈশবের সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
অর্পার বাবার বদলির কারণে যখন এক মফস্বল গ্রামে থাকতে হয়েছিল, তখনই নন্দিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তারা এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে একজন ছাড়া আরেকজন এক মুহূর্তও থাকতে পারত না!
কিন্তু পাঁচ বছর পর, অর্পার বাবার ঢাকায় বদলি হলে, তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খুঁজেও নন্দিতার পরিবারের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বন্ধুর শোকে দীর্ঘদিন কষ্টে কাটিয়েছে অর্পা। ধীরে ধীরে বুঝে নিয়েছিল— হয়তো আর কোনোদিন নন্দিতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না...
কিন্তু এই বইমেলা আজ আবার তাদের এক করল!
অর্পা: "কেউ যদি স্বেচ্ছায় হারিয়ে যায়, তবে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না..."
নন্দিতা: "বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা নানাবাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। তোর দেওয়া ফোন নম্বরটা কোথায় যে হারিয়ে গেল! আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম, ভাবতাম তুই হয়তো কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ করবি... কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না..."
অর্পা এক মুহূর্ত দেরি না করে নন্দিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল!
দুজনের চোখেই জল।
অর্পা ও নন্দিতা প্রতিজ্ঞা করল— বইমেলা যখন তাদের আবার এক করেছে, তারা প্রতি বছর এই দিনে একসঙ্গে বইমেলায় আসবে!
বন্ধুত্বের এই দৃঢ় বন্ধনের সাক্ষী হয়ে রইল বইমেলা...
