নানুর চেঁচামেচিতে ঠিকমতো ঘরের জানালাগুলো লাগাতে পারলাম না। একে তো পুরোনো ঘর, তার উপর কাঠের ঘুণে ধরে আসবাবপত্র হওয়ায় একটু উনিশ-বিশ হলেই ভেঙে যায়। বর্ষা আমার ভীষণ অপছন্দের। কেননা বর্ষায় টিনের চালের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির জল ঘরে ঢুকে। সেবার বৃষ্টিতে আমার বইগুলো ভিজে একেবারে একাকার হয়ে গেছিলো। সূর্যের আলোয় শুকোনার পরে পড়তে পেরেছিলাম। এখন রাত হলেই ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। নানু চিৎকার শুনে কেউ আসার আগেই তড়িঘড়ি করে তালা লাগিয়ে বের হয়ে পরেছি। উদ্দেশ্য থানার গিয়ে অভিযোগ করবো। কিন্তু সেটা আর হলো না। বাইরে তাকিয়ে দেখি উঠোনে জল থৈথৈ করছে।আমার চোখের সামনে আমার প্রিয় বাড়ি জলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেই বাড়ি যেখানে আমার জীবনের প্রতি মুহূর্তের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই বাড়ি যাকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ আমাকে.....তারপর আর মনে নেই।
সৌম্যর ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। সৌম্যকে এই সম্পর্কে আর কিছু বললাম না। কারণ কাল আমরা নতুন এক গ্রাম্য-শহরে এসেছি। গ্রাম্য-শহর বলছি এই কারণে যে শহরে হলেও এখানে গ্রামের সব কিছু রয়েছে। বিকালে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আবার মনে হলো সেই স্বপ্নের কথা, প্রতি রাতে যে স্বপ্ন দেখে ঘুমেই চিৎকার করে উঠে বসি। অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করায় সৌম্যজিৎ আমাকে নিয়ে বাংলোয় ফিরে আসে। কিন্তু আমি তখনো স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার একটা মিল খুঁজে চলেছি। কেউ বলতে পারেনা কেন এই স্বপ্ন দেখি।দেশ-বিদেশে কত ডাক্তার দেখিয়েছি। আমার জন্য মানুষের কত কথা শুনতে হয় সৌম্যকে। কেউ বলে আমাকে জ্বীনে ধরেছে, তো কেউ বলে আমাকে কেউ জাদুমন্ত্র করেছে আবার কেউ বলে আমি পাগল হয়ে গেছি।আজ এখানে এসে স্বপ্নটার কথা বারবার মনে পরছে। ঐদিকে সৌম্য কার সাথে জানি ফোনে কথা বলছে। ওর কথা বলা শেষ হতেই সৌম্যর কাছে ঐ জায়গায় যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলাম।
-সৌম্য, আমি ঐ জায়গাতে আবার যেতে চাই। ঐ জায়গার সাথে আমার এই স্বপ্ন দেখার একটা যোগসূত্র আছে। আমাকে সেটা খুঁজে বের করতেই হবে। আমাকে এখুনি নিয়ে চলো। এই স্বপ্ন, আমি আর নিতে পারছি না। -না, নয়ন, তোমাকে নিয়ে আমি আর রিস্ক নিতে চাচ্ছি না। আমাকে এই ব্যাপারে কিছু করতে বলোনা। আমি করতে পারবো না।
- আমাকে নিয়ে এই ব্যাপারে রিস্ক কি আছে?
- তুমি সেটা বুঝবে না নয়নতারা। জেদ করোনা তারা। আমিও আর জেদ করিনি। আমি সৌম্যকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি সৌম্য আমাকে ভালোবাসে। আমার এত রাগ-জেদের পরেও আমাকে সহ্য করে যাচ্ছে।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে চিলেকোঠার ঘর থেকে আমি একটা ডায়েরি খুঁজে পাই। ডায়েরির মূল পৃষ্ঠায় লেখা 'আত্মকথা'। আগ্রহ নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখি ডায়েরির হাতের লেখার সাথে আমার হাতের লেখার হুবহু মিল। কিন্তু আমি কখন এই ডায়েরিতে লিখেছি মনে নেই। হতে পারে অন্য কারোর এটা যার সাথে আমার হাতের লেখার মিল আছে। কার সাথে এতো মিল সেটা জানার জন্য ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলি।
- সৌম্যজিৎ, আমি আমার অতীতে ফিরে যাবো।
- কোন অতীতের কথা বলছো,তারা?
- সেই অতীত যেখানে আমি তোমাকে প্রত্যাখান করছিলাম। সৌম্যজিৎ ভয় পেয়ে যায় আমার কথায়। এসি থাকা সত্ত্বেও ঘামতে শুরু করে সৌম্যজিৎ।
- সৌম্যজিৎ, আমি সত্যিটা জেনে গেছি। দুই বছর ধরে দেখা যেই স্বপ্নের রহস্য কেউ সমাধান করতে পারেনি, আজ অন্ধকারে এক ফালি সূর্যের আলোয় স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। আমাকে কি তুমি নিজেই সেখানে নিয়ে যাবে না কি আমি একা যাবো?
- তুমি যেহেতু সব জেনে গেছো তাহলে তোমাকে আটকে রাখবো না।
৭২ ঘণ্টা পরে সেই জায়গায় এসে আমার প্রিয় বাড়িটাকে খুঁজে শুরু করি।
তারপর আমি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠি, চিৎকার শুনে বাসার সবার ঘুম ভেঙে যায়। এতক্ষণ কি তাহলে আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? জয়কে জিজ্ঞেস করলাম। বরাবরের মতো এবারেও একই উত্তর, আমি স্বপ্নই দেখেছি।
আশেপাশে গুনগুনিয়ে কে যেন গেয়ে উঠলো রবি ঠাকুরের সেই গান- কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয়না। মাঝেমাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাইনা।
বিগত ১০ বছর ধরে প্রায় রাতেই আমি এক স্বপ্ন দেখছি আর উদ্ভট সব কাজকারবার করছি । আমার জন্য ওর জীবন পর্যন্ত অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমি যে একটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যক্তি সেটা কেউ আমাকে স্বপ্নে বারবার বোঝাতে চাইছে কিন্তু আমি তা মেনে নিতে পারলেও সে মেনে নিতে চাইছেনা কেন? জানি,এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছেই নেই!
পরের দিন সকালে সবাই মিলে বরিশালের উদ্দেশ্যে লঞ্চে করে রওনা দিলাম । বরিশাল বিয়ে বাড়িতে পৌঁছানোর পর থেকে নিজের ভেতরে কি জানি হতে শুরু করল। মনে হচ্ছে এ জায়গায় আমি আগেও এসেছি, এ আমার চির পরিচিত জায়গা যেখানে আমার জীবনের যোগসূত্র রয়েছে। কেন আমার এরকম অনুভূতি হচ্ছে?
২দিন পরে খবরের শিরোনাম- বরিশালে অসচেনতায় লঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে এক নারীর মৃত্যু।
আমি ইচ্ছে করেই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছি! পানি ই যে আমাকে কাছে টানছিলো বারবার৷