শাশ্বতীর গল্প

শাশ্বতীর গল্প

বিয়ের পর দশ বছর কি করে যে পেরিয়ে গেল শাশ্বতী টেরই পায়নি। আজ শাশ্বতী তার বাপের বাড়িতে এসেছে। অবশ্য সে তার ছেলেমেয়ে, স্বামী, সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। আজ শাশ্বতীর বাপের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান। বড় ভাইয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে দাদা, বৌদি, বাবা,মা,ছোট ভাইয়ের সাথে দিনটি বেশ কাটলো।

পরদিন সকালে শাশ্বতী পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাপের বাড়িতে এলেই শাশ্বতী তাদের সাথে দেখা করে। শাশ্বতীর প্রিয় বান্ধবী মণিকার এই পাশের পাড়াতে তার বাবার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। শাশ্বতী বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানে যায়। চিপস, বিস্কুট, চানাচুর পাউরুটি,চকলেট কেনার পরে একটা মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টিও কিনে। খালি হাতে তো আর কারোর বাড়িতে যাওয়া যায় না। দোকান হতে বের হওয়ার সময় একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে সব কিছু নিচে পড়ে যায়। শাশ্বতী লোকটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে আরে,এ তো কিরণদা। শাশ্বতীর জীবনের প্রথম ভালোবাসা কিরণ। শাশ্বতী ভাবতেই পারেনি হঠাৎ এভাবে তাকে কিরণের সম্মুখীন হতে হবে। শাশ্বতীর চোখের সামনে আজ আবার সব কিছু ভেসে ওঠছে। কিরণ দা আমার দাদার ক্লাসমেট, তাই আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল।

একদিন দুপুরে কোথা থেকে এসে আমার ঘরে ঢুকে বসে পড়ে। তারপর আমাকে ভালোলাগার কথা বলে। আগে থেকেই কিরণদা আমাকে ফলো করতো। এদিকে কিরণদার বাবার হঠাৎ অসুখ হয়,চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষার জন্য কিরণদা ওদের সাথে যায়নি। থাকা-খাওয়ার কষ্ট হবে ভেবে মা ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসে। ২৪ ঘণ্টাই আমার পিছনে লেগে থাকতো দুজনে মানে আমার দাদা আর সে। তখন প্রায় ২ মাস কিরণদা আমাদের বাড়িতে ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ আমি কিরণের স্ত্রী থাকতাম! কিন্তু বিধাতা আমার কপালে কিরণের নাম,ওর ভালোবাসা রাখেনি। তাইতো সুস্থ হওয়ার পরে একদিন জ্যাঠামশাই হুট করে মারা যায় আর ওদের পরিবার এলাকা ছেড়েই চলে যায়। কোনো যোগাযোগ রাখেনি সে। শুধু আমার বিয়ের দিনে এসে আমাকে বলেছিল,"তুই আমার প্রথম প্রেম। তুই যাই ভাবিস না কেন চিরকাল তোকে ভালবেসে যাবো। " আজ এই দোকানে দাঁড়িয়ে আমি আর ওর দিকে তাকাতে পারিনি।মাথা নিচু করেই ওকে জিজ্ঞেস করি, " কেমন আছো? আমি ভালোই আছি।"

– "আমি ভালো নেই। আমি আজও তোকে ভালবাসি। তোর কথা সবসময়ই ভাবি। নাই বা তুই চাইলি, আমি দূর থেকে বছরের পর বছর তোকে দেখবো আর ভালোবাসবো।" প্রত্যুত্তরে শাশ্বতীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কিরণদা চলে যায়। একটা রিকশা ডেকে শাশ্বতী তার মধ্যে ওঠে পড়ে।

কলিংবেলে শব্দ হতেই একটা বাচ্চা এসে দরজা খুলে দিয়ে দৌড়ে তার মাকে ডাকতে চলে যায়। একটু পরেই মেয়েটি মণিকাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়। অনেকদিন পরে দেখা হওয়ায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। গল্প করতে করতে একসময় মণিকা জিজ্ঞেস করে- "আচ্ছা, আমাদের শৈশবের দিনগুলো তোর মনে পড়ে? " -"ও মা, মনে পড়বে না আবার। তুই ছোটবেলায় তো একটা ভীতুর ডিম ছিলি।রিয়া,রূপা,ইশিকা,রাজু,রায়ান সবার কথাই মনে পড়ে। কিন্তু তুই ছাড়া কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। "

  • "হ্যাঁ রে,সৌমেনের কথা মনে নেই তোর?"

সৌমেন! সৌমেন নামটা শুনেনেনেই শাশ্বতী চমকে ওঠে। হাই স্কুলে সৌমেনের রোল ছিল 'এক' আর ওর ছিল দুই রোল। কোনোদিন সৌমেনকে টপকে প্রথম হতে পারেনি শাশ্বতী,কখনো পারবে না। প্রথম না হওয়ায় শাশ্বতীর মনে কোনো আক্ষেপ ছিল না,ছিল না সৌমেনের ওপর কোনো রাগ,ছিল সৌমেনের প্রতি ভালোলাগা। কানামাছি খেলার সময় মাঝেমাঝেই ইচ্ছে করে সৌমেনকে জড়িয়ে ধরতো শাশ্বতী। না,প্রেম হয়নি ওদের দুজনের মধ্যে। তার আগেই কিরণ এসে পড়ে শাশ্বতীর জীবনে। ধীরে ধীরে শাশ্বতীর জীবন থেকে সৌমেন নামটা হারিয়ে যায়। আজ আর হাইস্কুলের ফাস্টবয় নেই সৌমেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। ১৫/২০ বছর পরে যখন দেখা হল, শাশ্বতীর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারেনি সৌমেন। শাশ্বতীকে তুই করে বলার বদলে আপনি করে সম্বোধন করেছিল সৌমেন। ফোন নাম্বার শাশ্বতীই চেয়েছিল তবে ছোটবেলার কাছের বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য যখন সৌমেনের থেকেই অনুমতি নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে, তখনই বুঝতে বাকি ছিল না সৌমেন সত্যি আর সেই সৌমেন নেই। ফোনের রিংটোন শুনে শাশ্বতীর ঘোর কাটে। ছোট মেয়ে খেলতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মণিকার বাসা থেকে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় শাশ্বতী।

কিছুদিন পরে সুস্থ হওয়ায় মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে শাশ্বতী কালকে রাতে। এতোদিন মেয়ের স্কুল বন্ধ,পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে তাই আজকেই মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলো শাশ্বতী। মেয়েকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে একটা বই পড়তে পড়তে পুরোনো ইচ্ছেগুলো মনে হতে থাকলো।

যখন ছোট ছিলাম ভেবেছিলাম বিজ্ঞানী হয়ে কত কিছু আবিষ্কার করবো। যেমন কীভাবে বৃষ্টি হয়, সূর্য কেন পশ্চিমে ওঠে, পেঁয়াজ কাটার সময়ে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন ইত্যাদি। বড় হয়ে দেখি সব কিছু আবিষ্কার হয়ে গেছে। আবার স্কুলে সায়েন্স পড়ার সময় ভাবলাম ডাক্তার হয়ে গরীবদের ফ্রি-তে চিকিৎসা করবো। কিন্তু দেখলাম ডাক্তার হওয়া আমার কপালে নেই। মাধ্যমিকে এতো খারাপ রেজাল্ট করলাম যে কোনো সরকারি কলেজে আমার চান্স হয়নি। তখন অবশ্য কিরণের সাথে আমার প্রেমের আদানপ্রদান চলছে।

শেষে একটা বেসরকারি কলেজে হিউম্যানিটিস গ্রুপে ভর্তি হলাম। এরপর ভাবলাম লেখক হবো,নিজের মনের কথাগুলো প্রকাশ করবো। কিন্তু লেখকদের গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে দেখি, আমি যা ভেবেছি তা অনেক আগেই মানুষ লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছে। আমি আর কি লিখবো? না, আমার আর নিজের কথা লেখা হলো না! আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়,অক্ষরে অক্ষরে আমার মনের কথা যে কবেই লেখা হয়ে গেছে।এই জীবনে আমার কি তবে কিছুই হওয়া হলো না? আচমকা 'মা' ডাক শুনে শাশ্বতী চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে রিমলী ওর কাছেই আসছে,স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। এইতো আমি জীবনে একটা কিছু অন্তত হতে পেরেছি, আমি 'মা' হতে পেরেছি,আমার নারী জন্ম সার্থক করতে পেরেছি।

বিয়ের পর দশ বছর কি করে যে পেরিয়ে গেল শাশ্বতী টেরই পায়নি। আজ শাশ্বতী তার বাপের বাড়িতে এসেছে। অবশ্য সে তার ছেলেমেয়ে, স্বামী, সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। আজ শাশ্বতীর বাপের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান। বড় ভাইয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে দাদা, বৌদি, বাবা,মা,ছোট ভাইয়ের সাথে দিনটি বেশ কাটলো।

পরদিন সকালে শাশ্বতী পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বাপের বাড়িতে এলেই শাশ্বতী তাদের সাথে দেখা করে। শাশ্বতীর প্রিয় বান্ধবী মণিকার এই পাশের পাড়াতে তার বাবার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। শাশ্বতী বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে একটা স্টেশনারি দোকানে যায়। চিপস, বিস্কুট, চানাচুর পাউরুটি,চকলেট কেনার পরে একটা মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টিও কিনে। খালি হাতে তো আর কারোর বাড়িতে যাওয়া যায় না। দোকান হতে বের হওয়ার সময় একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে সব কিছু নিচে পড়ে যায়। শাশ্বতী লোকটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে আরে,এ তো কিরণদা। শাশ্বতীর জীবনের প্রথম ভালোবাসা কিরণ। শাশ্বতী ভাবতেই পারেনি হঠাৎ এভাবে তাকে কিরণের সম্মুখীন হতে হবে। শাশ্বতীর চোখের সামনে আজ আবার সব কিছু ভেসে ওঠছে। কিরণ দা আমার দাদার ক্লাসমেট, তাই আমাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল।

একদিন দুপুরে কোথা থেকে এসে আমার ঘরে ঢুকে বসে পড়ে। তারপর আমাকে ভালোলাগার কথা বলে। আগে থেকেই কিরণদা আমাকে ফলো করতো। এদিকে কিরণদার বাবার হঠাৎ অসুখ হয়,চিকিৎসার জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষার জন্য কিরণদা ওদের সাথে যায়নি। থাকা-খাওয়ার কষ্ট হবে ভেবে মা ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসে। ২৪ ঘণ্টাই আমার পিছনে লেগে থাকতো দুজনে মানে আমার দাদা আর সে। তখন প্রায় ২ মাস কিরণদা আমাদের বাড়িতে ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ আমি কিরণের স্ত্রী থাকতাম! কিন্তু বিধাতা আমার কপালে কিরণের নাম,ওর ভালোবাসা রাখেনি। তাইতো সুস্থ হওয়ার পরে একদিন জ্যাঠামশাই হুট করে মারা যায় আর ওদের পরিবার এলাকা ছেড়েই চলে যায়। কোনো যোগাযোগ রাখেনি সে। শুধু আমার বিয়ের দিনে এসে আমাকে বলেছিল,"তুই আমার প্রথম প্রেম। তুই যাই ভাবিস না কেন চিরকাল তোকে ভালবেসে যাবো। " আজ এই দোকানে দাঁড়িয়ে আমি আর ওর দিকে তাকাতে পারিনি।মাথা নিচু করেই ওকে জিজ্ঞেস করি, " কেমন আছো? আমি ভালোই আছি।"

– "আমি ভালো নেই। আমি আজও তোকে ভালবাসি। তোর কথা সবসময়ই ভাবি। নাই বা তুই চাইলি, আমি দূর থেকে বছরের পর বছর তোকে দেখবো আর ভালোবাসবো।" প্রত্যুত্তরে শাশ্বতীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কিরণদা চলে যায়। একটা রিকশা ডেকে শাশ্বতী তার মধ্যে ওঠে পড়ে।

কলিংবেলে শব্দ হতেই একটা বাচ্চা এসে দরজা খুলে দিয়ে দৌড়ে তার মাকে ডাকতে চলে যায়। একটু পরেই মেয়েটি মণিকাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়। অনেকদিন পরে দেখা হওয়ায় একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। গল্প করতে করতে একসময় মণিকা জিজ্ঞেস করে- "আচ্ছা, আমাদের শৈশবের দিনগুলো তোর মনে পড়ে? " -"ও মা, মনে পড়বে না আবার। তুই ছোটবেলায় তো একটা ভীতুর ডিম ছিলি।রিয়া,রূপা,ইশিকা,রাজু,রায়ান সবার কথাই মনে পড়ে। কিন্তু তুই ছাড়া কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। "

  • "হ্যাঁ রে,সৌমেনের কথা মনে নেই তোর?"

সৌমেন! সৌমেন নামটা শুনেই শাশ্বতী চমকে ওঠে। হাই স্কুলে সৌমেনের রোল ছিল 'এক' আর ওর ছিল দুই রোল। কোনোদিন সৌমেনকে টপকে প্রথম হতে পারেনি শাশ্বতী,কখনো পারবে না। প্রথম না হওয়ায় শাশ্বতীর মনে কোনো আক্ষেপ ছিল না,ছিল না সৌমেনের ওপর কোনো রাগ,ছিল সৌমেনের প্রতি ভালোলাগা। কানামাছি খেলার সময় মাঝেমাঝেই ইচ্ছে করে সৌমেনকে জড়িয়ে ধরতো শাশ্বতী। না,প্রেম হয়নি ওদের দুজনের মধ্যে। তার আগেই কিরণ এসে পড়ে শাশ্বতীর জীবনে। ধীরে ধীরে শাশ্বতীর জীবন থেকে সৌমেন নামটা হারিয়ে যায়। আজ আর হাইস্কুলের ফাস্টবয় নেই সৌমেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অধ্যাপক। ১৫/২০ বছর পরে যখন দেখা হল, শাশ্বতীর চোখের দিকে তাকিয়ে ঠিকমতো কথা বলতে পারেনি সৌমেন। শাশ্বতীকে তুই করে বলার বদলে আপনি করে সম্বোধন করেছিল সৌমেন। ফোন নাম্বার শাশ্বতীই চেয়েছিল তবে ছোটবেলার কাছের বন্ধুর সাথে কথা বলার জন্য যখন সৌমেনের থেকেই অনুমতি নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে, তখনই বুঝতে বাকি ছিল না সৌমেন সত্যি আর সেই সৌমেন নেই। ফোনের রিংটোন শুনে শাশ্বতীর ঘোর কাটে। ছোট মেয়ে খেলতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মণিকার বাসা থেকে দ্রুত হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় শাশ্বতী।

কিছুদিন পরে সুস্থ হওয়ায় মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে শাশ্বতী কালকে রাতে। এতোদিন মেয়ের স্কুল বন্ধ,পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে তাই আজকেই মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলো শাশ্বতী। মেয়েকে ক্লাসে পৌঁছে দিয়ে ওয়েটিং রুমে বসে একটা বই পড়তে পড়তে পুরোনো ইচ্ছেগুলো মনে হতে থাকলো।

যখন ছোট ছিলাম ভেবেছিলাম বিজ্ঞানী হয়ে কত কিছু আবিষ্কার করবো। যেমন কীভাবে বৃষ্টি হয়, সূর্য কেন পশ্চিমে ওঠে, পেঁয়াজ কাটার সময়ে মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ে কেন ইত্যাদি। বড় হয়ে দেখি সব কিছু আবিষ্কার হয়ে গেছে। আবার স্কুলে সায়েন্স পড়ার সময় ভাবলাম ডাক্তার হয়ে গরীবদের ফ্রি-তে চিকিৎসা করবো। কিন্তু দেখলাম ডাক্তার হওয়া আমার কপালে নেই। মাধ্যমিকে এতো খারাপ রেজাল্ট করলাম যে কোনো সরকারি কলেজে আমার চান্স হয়নি। তখন অবশ্য কিরণের সাথে আমার প্রেমের আদানপ্রদান চলছে।

শেষে একটা বেসরকারি কলেজে হিউম্যানিটিস গ্রুপে ভর্তি হলাম। এরপর ভাবলাম লেখক হবো,নিজের মনের কথাগুলো প্রকাশ করবো। কিন্তু লেখকদের গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে দেখি, আমি যা ভেবেছি তা অনেক আগেই মানুষ লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছে। আমি আর কি লিখবো? না, আমার আর নিজের কথা লেখা হলো না! আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়,অক্ষরে অক্ষরে আমার মনের কথা যে কবেই লেখা হয়ে গেছে।এই জীবনে আমার কি তবে কিছুই হওয়া হলো না? আচমকা 'মা' ডাক শুনে শাশ্বতী চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে রিমলী ওর কাছেই আসছে,স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। এইতো আমি জীবনে একটা কিছু অন্তত হতে পেরেছি, আমি 'মা' হতে পেরেছি,আমার নারী জন্ম সার্থক করতে পেরেছি।

মহাখালী থেকে শাহবাগ আসার জন্য বিআরটিসি বাসে ওঠেই সিট পেয়ে মনে হচ্ছিলো চাঁদ পেয়ে গেছি নয়তো এই শহরে লোকাল বাসে মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকাটা কত কষ্টদায়ক, আমি সেটার মুখোমুখি হতে চাই না। যাই হোক,সিটে বসেই সময় গুণতেছি কখন বাসায় পৌঁছাবো। ক্ষুধা আমি মোটেও সহ্য করতে পারিনা, সেই কখন খেয়েছি। বাস বিজয় সরণী আসার পর অন্য অনেক মানুষের সাথে এক মা-মেয়ে বাসে ওঠলো। বাসে তখন বসার জন্য কোনো জায়গা তো নেই, এমনকি দাঁড়িয়েও কেউ যেতে পারবেনা। ছোট মেয়েকে কোলে বসার জন্য অনেকেই রিকোয়েস্ট করলো কিন্তু কি কারণে মেয়েটা এসে একদম আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে আমি ডাকিনি কিন্তু মনেমনে চাইছিলাম সে যেন পুরুষদের কাছে গিয়ে না দাঁড়ায়। মেয়েটা মায়ের হাত ধরে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। একটু পরে আমার কোলে বসলো আমিও বাধা দিলাম না। এই ফাঁকে আমি আমার জন্মদাত্রী মাকে কল করে নিজের বর্তমান লোকেশন জানিয়ে দিলাম,এটা আমার রেগুলার রুটিন ওয়ার্ক। কথা শেষ হতে শুনি মা-মেয়ের কথোপকথন ---

-মা, একটু তাকাও তো দেখি আমার দিকে। তোমার চোখের কোণা থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। -কই না তো! তুমি ভুল দেখছো বাবু। -আমি ভুল দেখিনি মা। ডাক্তার বারবার নিষেধ করার পর তুমি কেন কান্না করছো মা?

  • বড় হয়ে তুই বুঝবি এই কান্না।
  • আমি তো বড় হয়েই গেছি, এই যে তোমাকে হাত ধরে একটু বাসে ওঠলাম। একটু মাথাটা নিচু করো, তোমার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছি।

মেয়ে যখন চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে তখন ভালোভাবে তাকিয়ে খেয়াল করলাম ভদ্রমহিলার এক চোখে সেলাই করা,জলের মতো কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। খুব সম্ভবত অপারেশন থেকেই ইনফেকশন হয়েছে।

-মা, তোমার কপালের টিপ কই? কোথাও পড়ে গেছে নাকি দিতেই ভুলে গেছো। তোমাকে নিয়ে পারিনা আর। আমাকে তো কত সুন্দরভাবে সাজিয়ে দাও কিন্তু এখন নিজে সাজো না। দাঁড়াও, আমার পকেট থেকে বের করে তোমাকে টিপ পড়িয়ে দিচ্ছি।

  • কিরে তুই তাহলে টিপের এই বক্সটা নিয়েছিস! আর আমি ভাবলাম এটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছে তোর দিদা।
  • তোমার জন্যই তো নিয়েছি এটা। তুমি টিপ পড়তে ভুলে যাও কেন মা!
  • কি জন্য যে এখন সবকিছু ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার চিন্তা নেই কারণ আমার তো তুই আছিস,আমার আয়না তুই। তোর চোখে সব কিছু ধরা পড়বেই আমি জানি।
  • টিপ আর সিঁদুর পড়লে তোমাকে কত সুন্দর লাগে। মনে হয়,শুধু তোমাকেই দেখি মা। তুমি এভাবেই থাকবে সবসময়, আর কিছু দেখতে চাই না আমি।

মা-মেয়ের এই কথোপকথনের মধ্যেই বাস ভাড়া চাইতে এগিয়ে এলো এক ছেলে। এই ভিড়ের মধ্যে কিভাবে বাস ভাড়া চাইতে আসে, বুঝতে পারলাম না। আমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিলাম। মেয়েটি তখন জিজ্ঞেস করলো- শাহবাগ কত টাকা ভাড়া?

  • ৫০ দেইন। মেয়েটি তার ছোট্ট পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে দিলো। ফেরত পাওয়া টাকাটা গুণেগুণে হিসাব করে রাখলো। এইটুকু ছোট মেয়ের এই আচরণ! হয়তো মা নিজেই একদিন শিখিয়েছে। বিজয় সরণীর জ্যাম পার হয়ে ফার্মগেটে আসার পর আমার সামনেই একটা সিট ফাঁকা হতেই মেয়েটি অসুস্থ মাকে নিয়ে চলে গেলো সেখানে। যাওয়ার আগে বললো- ধন্যবাদ আন্টি।

আমি প্রতিউত্তরে মুচকি হাসি দিলাম তার দিকে তাকিয়ে। সিটে বসে মেয়েটি মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কি জানি বলছিলো। মা-মেয়ের কথোপকথন শুনতে না পেরে এবার খুব হিংসা হচ্ছিলো।

কিছুক্ষণ পর শাহবাগে এসে বাস থেকে নামার সময় দেখি মাকে হাতে ধরে বাস থেকে নামাচ্ছে মেয়ে। পিছনে পিছনে আমিও নামলাম। মা-মেয়ে একে-অপরের হাত ধরে এই শহরে রাস্তা পার হচ্ছে। এরকম দৃশ্য কি কখনো আমার জীবনে হবে?