এখনো সূর্য উদিত হয়নি। চারপাশে শুনশান নীরবতা। যেহেতু উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের বসবাস এখানে, তারা প্রায় শেষ রাতে ঘুমোতে যায়। এখন ঠিক সেই সময়। তার ওপর আজকে শুক্রবার। পাখির কলতান জানান দিচ্ছে একটু পরেই হবে ভোর। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ডাক। এই সোসাইটির রাস্তাগুলোর পাশে যেই ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেই ল্যাম্পপোস্টের মাঝ বরাবর টবসহ ফুলের গাছ দেখা যায়। ফুল ফুটে থাকে তাতে। চমৎকার লাগে দেখতে। সৈকতের সবচেয়ে বড় পরিচয়, নি:সঙ্গ। দারোয়ানের ঘুম ভাঙিয়ে সে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। তার মনটা আজকে আনচান করছে কোনো এক কারণে। এই ভোরে রাস্তায় দু'একটা ট্রাকের দেখা পাওয়া যায়। কিছুদূর যেতেই একটা অ্যাম্বুলেন্স ঝড়ের গতিতে ছুটে আসে। গতির ঝড় থামে সৈকতের সামনে এসে। খুলে যায় অ্যাম্বুলেন্সের দরজা। "ভাই, আপনার রক্তের গ্রুপ কি বি পজিটিভ?" সৈকত ভ্রু কুঁচকে বলে, "রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে রক্তের গ্রুপ জিজ্ঞেস করে কে?" আগন্তুক লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বিবরণ দেওয়া শুরু করে, "এই মানুষটাকে আমি রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখি আধা ঘণ্টা হবে। পুরো রাস্তা রক্তে মাখা ছিলো। এক্সিডেন্ট করেছে বোঝা যায়। পাশে তার আইডি কার্ড পড়ে ছিলো। দেখে বুঝলাম তার বয়স পঁচাত্তর বছরের মতো। রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। রাস্তায় একজন মানুষ নাই।" "ফোন নাই আপনার কাছে? পরিচিত কাউকে ফোন করেন।" "আমার ফোন আজকে চোরে নিয়ে গেছে। ভাই, সময় অনেক কম। একটু দ্রুত বলেন।" "বি পজিটিভ, চলেন।" অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সাথে সাথে আবারও শুরু হয় গতির ঝড়। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথে দেখা গেলো স্ট্রেচারে করে লাশ বের করা হচ্ছে। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশ। সৈকত চোখ সেদিকে রাখতেই তার চোখ ভেজে ওঠে জলে। মৃত্যুর মতো কঠিন বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন হলেও আমাদের মেতে নিতে হয়। ইমার্জেন্সিতে প্রবেশ করানো হলো রোগীকে। আইডি কার্ড দেখে তার নাম শনাক্ত করা হয়েছে, নাম আব্দুর রহমান। করিডোরে দাঁড়িয়ে সময়ের সাথে লড়াই করছে সৈকত এবং হাসপাতালে নিয়ে আসার মতো উদ্যোগ নেওয়ার মতো মহৎ কাজ করা মানুষটা। তার নাম সেলিম। এর কিছুক্ষণ আগে সৈকতের থেকে রক্ত নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। ডাক্তার ইমার্জেন্সি থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, "আপনারা ঠিক সময় মতো উনাকে নিয়ে এসেছেন। বয়স্ক মানুষ। আরেকটু দেরি হলে বাঁচানো কঠিন হয়ে যেতো।" সৈকতকে ধন্যবাদ দিতে ভুলেন না ডাক্তার। তার দেওয়া রক্তে বাঁচলো একটা প্রাণ। আব্দুর রহমানকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। সৈকত এবং সেলিম তার পাশে গিয়ে বসে। চোখ মেলতে দেখা যায় রহমানকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, "তোমরা কারা? আমি তো জানতাম আমার কেউ নাই। তাহলে তোমরা কারা?" সেলিম বলে, "আমরা কেউ না, চাচা। আমরা মানুষ।" এ কথা বলার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচের দিকে তাকিয়ে সেলিম বিড়বিড় করে বলতে থাকে, অপরিচিত মানুষ কাছের মানুষ হয়ে ওঠে একসময়। তবে কিছু সম্পর্ক দীর্ঘ না হওয়া'ই ভালো। হারানোর ভয় থেকে বাঁচা যায়।" "কথা ধীরে বললেও আমি কিন্তু শুনছি। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি ম্যালা শিক্ষিত।" মুচকি হেসে ফেলে সেলিম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। সৈকত গিয়ে দেখে করিডরে চুপচাপ বসে আছে সেলিম। তার পাশে গিয়ে সৈকত বসে। শুরু হয় কথপোকথন। সেলিম বলে, "আপনাকে আমি একটা মিথ্যা কথা বলেছিলাম,ভাই।" "কোনটা?" "আমার ফোন চুরি হয়নি। পকেটেই আছে। আপনি বলেছিলেন, পরিচিত কাউকে ফোন করিনি কেন? আমার পরিচিত কেউ নাই। যারা ছিলো স্বার্থের কারণে আমাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আর অ্যাম্বুলেন্স আমি ফোন করেই ডেকেছিলাম।" "আমারও আমি ছাড়া আপন কেউ নাই। মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো। এখন তারা আর আমার খোঁজ নেয় না। আত্নীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব যা ছিলো দূরে সরে গেলো। তারা দেখেছিলো আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ভবিষ্যত অন্ধকার দেখে ফেলা মানুষরা আর পাশে থাকে না।" "আপনি কি করেন?" "একটা এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে আছি। আপনি?" "আমার ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করা হয়েছে। একটা ঔষধের দোকানে থাকি দু'বছর হলো। টাকা যা দেয় চলে যায়। একা মানুষ তো।" "হুম। আচ্ছা, আমাকেও যে এবার স্বার্থপরের মতো কাজ করতে হচ্ছে।" "কি সেটা?" "অনেকগুলো কাজ জমে আছে। বাসায় যেতে হবে।" "আমিও যাবো। নার্সকে বলে দেবো উনাকে যেন দেখে রাখে। আর কোনো দরকার হলে জানাতে।" "ঠিক আছে। আমি আসি তাহলে। এটা আমার নম্বর।" সকাল ৯:৩০। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে সৈকত। বাড়ি ফেরার কালে রাস্তায় জ্যাম থাকায় বাধ্য হয়ে তাকে ভিন্ন পথ বেছে নিতে হয়। ছুটির দিনেও এই যানজট অবিশ্বাস্য বলা যায়। অনেকদিন এই পথে আসা নেই তার। এই পথের অনেক স্মৃতি সে মাটি চাপা দিয়েছে। ফোনের নোটস খুলে সে টাইপ করতে থাকে, আদ্রিতা, সেই দিনের পর থেকে আমি আর একটানা অনেকদিন ভালো থাকিনি, থাকতে পারিনা । একা আমাকে আরও একা করে দিয়েছিলে তুমি। সূর্যের আলো এসে পড়লো আসিফের মুখে। সূর্যের আলোয় কাঁদতে নেই। কাঁদতে হয় আঁধারে, লোক চক্ষুর আড়ালে।