পেট্রিকোর : বৃষ্টি চলাকালীন সময়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া এক মিষ্টি সুবাস

পেট্রিকোর : বৃষ্টি চলাকালীন সময়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া এক মিষ্টি সুবাস

 
 
বৃষ্টিমুখর একটা দিন নিয়ে যদি আপনাকে বলা হয় কোন রচনা লিখতে, তখন বোধহয় আপনি এক নিমিষেই অজস্র প্রিয় বাক্য দিয়ে সাদা পৃষ্ঠাগুলো ভরে ফেলবেন। বৃষ্টি এলেই আমাদের অনেকের মনেই এক অদ্ভুত আনন্দের জোয়ার ভেসে উঠে। টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ আমরা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করি। খোলা জানালা দিয়ে যখন হুটহাট বৃষ্টির ছাট আমাদের গায়ে এসে পড়ে, তখন ইচ্ছে হয় যেন এক দৌড় দিয়ে বাইরে বের হয়ে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করি।বৃষ্টির ছন্দে আমাদের দেহ ও মন বরাবরই পুলকিত হয়। তবে বৃষ্টি হওয়ার পরপর আপনার চারপাশ যে এক অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণে ছেয়ে যায় তা কি কখনো লক্ষ্য করেছেন?
 
ছেলেবেলা থেকেই যারা বৃষ্টিপ্রেমী তাদের কাছে বৃষ্টি নামার পরক্ষণেই শুষ্ক মাটির সঙ্গে বৃষ্টির জলকণা গুলো মিশে যে একটা হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ তৈরি করে তা ভীষণ প্রিয়। বৃষ্টি এলেই যেন অনেকে মুখিয়ে থাকে পৃথিবীর বুকে ছেয়ে আসা সে সুবাসের পরশ পাওয়ার জন্য। এ প্রিয় সুবাসটির যে কোন বিশেষ নাম থাকতে পারে, তা হয়তো অনেকের কাছেই অকল্পনীয় এক বিষয় মনে হবে। তবে অবাক করার বিষয় হলেও এটা কিন্তু সত্য যে বৃষ্টির সাথে জুড়ে থাকা সে চিরপরিচিত সুবাসের একটা ভীষণ সুন্দর নাম আছে। ইংরেজিতে একে বলা হয় পেট্রিকোর (Petrichor)। যদি এর বাংলা অনুবাদ করা হয় তবে একে বলা যায়, "ভিজা মাটির সোঁদা গন্ধ"।
 
"পেট্রিকোর " শব্দটির ইতিহাস :
ধারণা করা হয় যে অস্ট্রেলিয়ান দুজন বিজ্ঞানী ইসাবেল জয় বেয়ার এবং রিচার্ড গ্রেনফেল থমাস ১৯৬৪ সালে বৃষ্টিকালীন পৃথিবীর বুকে ছেয়ে আসা এ অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণের নাম দেন "Petrichor"। এ শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত ভাবে গ্রিক ভাষার অন্তর্গত দুটি শব্দ, "পেট্রা" যার অর্থ হল কোন পাথর সদৃশ বস্তু ও "ইকর" অর্থাৎ গ্রিক মিথোলজিতে দেবতাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত সোনালি তরল পদার্থকে বুঝায় ; এ দুটো শব্দের সংমিশ্রণে মূলত পেট্রিকোর শব্দটির উৎপত্তি ঘটে।
১৯৬৪ সালের ২৭ জুন অস্ট্রেলিয়ার একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক জার্নালে সর্বপ্রথম পেট্রিকোর শব্দটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
 
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:
বৃষ্টির আগে, গাছ ও মাটির জীবাণু "জিওসমিন" নামক এক ধরনের অ্যালকোহল নির্গত করে। এটি খুব অল্প পরিমাণেই মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করতে পারে। কোন এলাকায় দীর্ঘদিন আবহাওয়া শুষ্ক থাকার ফলে যখন হঠাৎ করে শুকনো মাটিতে বৃষ্টি পড়ে, তখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মাটিতে আঘাত হানে এবং বায়ুর সাথে মিশে যায়। এ সময় বৃষ্টির ফোঁটা এবং মাটির ঘর্ষণে ছোট ছোট বুদবুদ সৃষ্টি হয় যা পরে ফেটে গিয়ে জিওসমিনযুক্ত ছোট বায়ুর কণা ঊর্ধ্বমুখী হয় এবং বৃষ্টির মনোরম সুবাস আমাদের নাকে পৌঁছে। পেট্রিকোরকে এজন্য অনেকে দীর্ঘদিন পর পাওয়া "প্রথম বৃষ্টির সুবাস " বলেও অভিহিত করেন।
 
প্রকৃতিতে এর প্রভাব :
পেট্রিকোর কেবল আমাদের ইন্দ্রিয়ের জন্য তৃপ্তিদায়ক নয়, এটি পরিবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এই সুগন্ধ গাছপালার বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে সহায়তা করে। এটি মাটির স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে এবং এতে থাকা জীবাণুগুলোর সক্রিয়তা বাড়াতে সহায়তা করে। গবেষকদের মতে মানুষের পাশাপাশি এটি বিভিন্ন পশুপাখির কাছেও ভীষণ পছন্দের একটি সুবাস।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সাহিত্য -সংগীত বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেট্রিকোর শব্দটির জনপ্রিয়তা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতির রহস্যময়ী সৌন্দর্য বরাবরই মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাই অনেক শিল্পীই বৃষ্টির এ মনোরম সুবাসকে তাদের শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার আহবায়ক হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন পারফিউম কোম্পানি পেট্রিকোরের সুবাসের আদলে বিভিন্ন সুগন্ধি পণ্য প্রতিনিয়ত বাজারে আনার চেষ্টা করছে।
 
মানুষ স্বভাবতই ভীষণ কৌতূহলপরবশ। প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনাগুলোকেও তারা গভীর বিশ্লেষণধর্মী চোখ দিয়ে পরখ করে। তাইতো বৃষ্টির মনোরম এ সুবাসকে ঘিরে মানুষের মধ্যে বরাবরই এক অজানা আগ্রহ কাজ করে। তাই বৃষ্টি এলেই এখনও আমরা প্রকৃতির সে সুমিষ্ট ঘ্রাণকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য ছেলেবেলার মতোই ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি।
 
নিশাত তাসমীম
কন্ট্রিবিউটর
Writer's Club BD