সাহিত্যে ভূতেদের আনাগোনা - হরর সাহিত্যের ক্রমবিকাশ

সাহিত্যে ভূতেদের আনাগোনা - হরর সাহিত্যের ক্রমবিকাশ

 

অজানাকে জানার কৌতূহল মানুষের চিরন্তন। সেই কৌতূহল থেকেই হয়তো অলৌকিক এর প্রতি আমাদের তীব্র আকর্ষণের সৃষ্টি। আমরা ধরেই নিই, অলৌকিক জগতের বাসিন্দা মানেই সে ভীষণ ভয়ঙ্কর , তা না হলেও কিম্ভূতকিমাকার নিশ্চয়ই। ছোটবেলায় নানু- দাদুর মুখে শোনা গল্পে ভূতেরা আর যাই হোক, সুদর্শন ছিল না। হয় তাদের ঠ্যাং বড়, নয়তো মাথা। গলার স্বর ও তেমন মিষ্টি নয়,শুনলে বরং পিলে চমকে যায়।

তবে এমন বিদঘুটে ভূতেদের নিয়ে যে কেউ একেবারে খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসে যাবে ,সেটা একটু আশ্চর্যের হলেও একেবারে অভাবনীয় নয়। তাই তো আমরা দেখি, ভূতেরা শুধু সাহিত্যে জায়গা দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি,সময়ের পরিক্রমায় তাদের গল্পগুলোর ডালপালাও বেশ প্রসারিত হয়েছে।পোশাক - আশাক আর খাবার-দাবারের পাশাপাশি ভূতেরাও কিভাবে যেন জড়িয়ে গেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। ভৌতিক গল্পগুলোয় একটু নজর দিলে বোঝা যায়, তাতে লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব নেহাৎ কম নয়। কাজেই অলৌকিক এর দুনিয়াকে প্রথম বইয়ের পাতায় আনার দুঃসাহস কে করলো তা আর খুঁজে কাজ নেই। মুখে মুখে যেসব গল্প ঘুরে বেড়িয়েছে হাজার বছর ধরে,তাদের বইবন্দি করা আর কি এমন কঠিন কাজ। তবুও লেখার খাতিরে খানিক ঘাটাঘাটি করে যা বের হলো তার ভিত্তিতে হরর সাহিত্যের যাত্রাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়।

গথিক হরর:

শুরুটা করেছিলেন হেনরি ওয়ালপোল তাঁর ' ক্যাসল অফ ওটরানটা ' বইটা দিয়ে। এই উপন্যাস এর মাধ্যমেই 'গথিক' টার্ম টা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যদিও গথিক আর হররের সাদৃশ্য ,বৈসাদৃশ্য নিয়ে কিছু মতবিরোধ আছে, তবু এই জনরার মাধ্যমে যে পরবর্তী হরর সাহিত্য বেশ প্রভাবিত হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। গথিক ফিকশন এর উপাদানগুলোই ছিল রোমাঞ্চকর। বিষণ্ণ আবহাওয়া , বিশালাকার প্রাচীন সব স্থাপত্য যার কোনায় কোনায় অন্ধকারে ঠাসা ,রহস্যের ঘনঘটা আর পাঠকদের মনে গেথে যাওয়া কিছু চরিত্র। ড্রাকুলা পাঠকদের কাছে এই রোমাঞ্চের স্বাদ চিরচেনা। স্যার ব্রাম স্টোকার তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসে গথিক থিমকে ব্যবহার করেছেন বেশ চমৎকারভাবে। এডগার অ্যালান পো এর রচনাসমূহ আর মেরি শেলীর 'ফ্রাঙ্কেস্টাইন' ও এই তালিকায় রয়েছে। ১৮ শতক থেকে ১৯ শতকের মাঝে এই গথিকের আবির্ভাবই পরবর্তীতে রূপ দিয়েছে আধুনিক হরর সাহিত্যের।

সাইকোলজিকাল হরর:

ভূতুড়ে পরিবেশ ছেড়ে এই ধাপে এসে লেখকরা চরিত্রায়নের প্রতি আরেকটু মনোযোগী হলেন। ফলস্বরূপ , মানবমনের বিচিত্র আর অন্ধকার সব অনুভূতি হরর সাহিত্যে উঠে আসতে লাগলো। প্রধান চরিত্রগুলোও কেমন একটু খাপছাড়া হয়ে উঠলো, তাদের চিন্তাচেতনাই আলাদা, মনের নাগাল পাওয়া দায়। আক্ষরিক ভূতের ভয় এর জায়গা দখল করে নিলো রাগ, হতাশা, আত্মগ্লানি আর জটিল মানসিক দ্বন্দ্ব। সাইকোলজিকাল হররগুলো প্রচলিত ভয়ের গল্পের থেকে আলাদা। কারণটা 'দ্য শাইনিং', স্টিফেন কিং এর 'দি গার্ল হু লাভড টম' বা শার্লি জ্যাকসন এর 'দ্য হান্টিং অফ হিল হাউস' এর মতো বইগুলো পড়লেই বোঝা যাবে। তবে বলা হয় যে, ১৯৭০ এর দিকে এই ধরণের কাহিনীর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমতে শুরু করে, পরবর্তীতে ৮০ থেকে ৯০ এর দশকে আবার সেটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। আর বর্তমানের হরর পাঠকদের কাছেও এই জনরার বেশ নামডাক রয়েছে।

আধুনিক হরর :

এই ধাপে এসে প্রযুক্তির খাতিরে বইয়ের পাতার ভূতেরা সিনেমার পর্দায় আবির্ভাব হতে শুরু করে। ভৌতিক সিনেমার ইতিহাস খুব বেশি নতুন না হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে তা বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাক। চিরচেনা ভূতের গল্পের সাথে কিছুটা সামাজিক বাস্তবতার মিশেলে কাহিনীগুলো দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা হয়। ফলে কল্পনার অলোকিক জগৎ যে গভীরভাবে মিশে আছে আমাদের লৌকিক সমাজববস্থার সাথে, দর্শকরা সেটাই উপলব্ধি করতে শুরু করে। সাহিত্যে আর পর্দায় পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নেয়ার পর ভৌতিক কাহিনীগুলো তাদের ডালপালা মেলতে থাকে। সৃষ্টি হয় হরর সাব-জনরার। ফোক হরর , কমেডি হরর, প্যারানরমাল হরর এমনকি আর্ট হররও এই তালিকায় জায়গা করে নেয়। মাঝে মাঝে থ্রিলার বা এডভেঞ্চার গল্পেও একটু-আধটু হররের দেখা মেলে। নিচের তালিকাটা গুগল থেকে নেয়া। তালিকায় আছে ২০২৫ এ সর্বাধিক পাঠক-সমাদৃত কিছু ভৌতিক গল্প আর উপন্যাস। (গুগল এর মতে)।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে ভৌতিক গল্পগুলোর বিক্রি আগের চেয়ে প্রায় ৫৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা যায়, ভূতসমাজের সাথে মানবসমাজের বেশ শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও এই শান্তি বজায় থাকবে এটাই আশা।

বাংলা সাহিত্যে হরর এর ক্রমবিকাশ কীভাবে হলো সে আলোচনা আরেকদিন হবে। আপাতত ভূতসমাজ এর ভূত আর ভবিষ্যৎ এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা এখানেই শেষ হলো।