পোস্ট আর্থকোয়েক ডিজিনেস সিনড্রোম

পোস্ট আর্থকোয়েক ডিজিনেস সিনড্রোম

সম্প্রতি ঢাকা শহর এবং আশেপাশের এলাকায় আমরা ভূমিকম্প অনুভব করেছি। ভূমিকম্প শুধু ভাঙা ভবন বা ফাটল ধরা রাস্তাই রেখে যায় না। অনেক মানুষের জন্য আসল সমস্যা শুরু হয় ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পর। এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রায়ই উপেক্ষিত একটি সমস্যা হলো “পোস্ট আর্থকোয়েক ডিজিনেস সিনড্রোম”। এটি সাময়িক কিন্তু অস্বস্তিকর একটি অবস্থা, যেখানে মানুষ মাথা ঘোরা, ভারসাম্যহীনতা বা মাটিই দুলছে এমন অনুভব করে। যারা আগে কখনো ভূমিকম্প অনুভব করেননি, তাদের জন্য এটি আরও বিভ্রান্তিকর হতে পারে। যদিও এটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো রোগ হিসেবে স্বীকৃত নয়, তবুও ডাক্তার এবং গবেষকেরা এটিকে একটি স্বাভাবিক ও বোঝার মতো মানসিক-শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন।

ভূমিকম্পের সময় শরীর হঠাৎ তীব্র সংবেদনশীল বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। চোখ দেখে চারপাশ কাঁপছে, ভেতরের কানে নড়াচড়া অনুভূত হয়, আর মস্তিষ্ক এই দুই রকম সংকেত মিলিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। ভূমিকম্প থেমে যাওয়ার পরও স্নায়ুতন্ত্র মনে করতে পারে যে বিপদ এখনো আছে। শরীর যা আশা করছে আর বাস্তবে যা ঘটছে এই মিল না হলে মাথা ঘোরা অব্যাহত থাকতে পারে। অনেকেই বলেন, পায়ের নিচে হালকা দুলুনি লাগে, যেন নৌকায় দাঁড়িয়ে আছেন। কেউ কেউ আবার হালকা মাথাব্যথা, অস্থিরতা, ভারসাম্যহীনতা বা চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন লাগার অভিযোগ করেন।

এ ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বড় ভূমিকা রাখে। ভূমিকম্প কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হয়, আর এর ভয় খুব শক্তিশালী। শরীর তখন প্রচুর অ্যাড্রেনালিন ছাড়ে, যা আমাদের পালাতে বা বাঁচতে প্রস্তুত করে। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেও শরীরকে স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগে। সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম তৎক্ষণাৎ শান্ত হয় না; এটি কিছু সময় অতিরিক্ত সতর্ক অবস্থায় থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে এই বাড়তি সতর্কতা মাথা ঘোরার সময়কে দীর্ঘ করে। শক্তিশালী আফটারশক থাকলে সমস্যা আরও বাড়ে, কারণ এতে শরীর আবার নতুন করে ভয় পায়।

আমাদের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভেতরের কানের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কানের ভেতরের অংশ নড়াচড়া শনাক্ত করে শরীরকে ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। ভূমিকম্পের সময় এসব অংশ অতিরিক্ত উদ্দীপিত হয়। কাঁপুনি থেমে গেলেও মস্তিষ্ক সাধারণ সংকেতকে ভুলভাবে নড়াচড়া হিসেবে ধরে নিতে পারে। এটি অনেকটা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর “স্থল অসুখ” বা ল্যান্ড সিকনেসের মতো। শরীর হঠাৎ স্থির পরিবেশে ফিরে এসে নতুন করে মানিয়ে নিতে সময় নেয়।

লক্ষণগুলো ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হলো:
* মাথা ঘোরা বা ভাসার অনুভূতি
* হঠাৎ ভারসাম্য হারানোর মতো লাগা
* চারপাশ হালকা কাত হয়ে আছে মনে হওয়া
* মাথাব্যথা
* বমি ভাব
* মনোযোগের ঘাটতি
* বিরক্তি
* ঘুমের সমস্যা

ক্লান্তি খুব সাধারণ, কারণ শরীর ভারসাম্য রাখতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। উদ্বেগও লক্ষণ বাড়াতে পারে। অনেকেই ভয় পান যে আবার ভূমিকম্প হবে, তারা গুরুতর অসুস্থ, কিংবা তারা নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

যদিও এই লক্ষণগুলো অস্বস্তিকর, তবে সুখবর হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি সাময়িক। মস্তিষ্ক এবং ভেতরের কান ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হলে সমস্যা কমে যায়। কয়েকটি সহজ উপায়ে সুস্থ হওয়া দ্রুত হতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম খুব জরুরি, কারণ ক্লান্তি মাথা ঘোরা বাড়ায়। পর্যাপ্ত পানি খেলে ভেতরের কানের কাজ ভালো হয়। হালকা হাঁটা-চলার মতো কাজ শরীরকে আবার স্বাভাবিক নড়াচড়ার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। অনেকেই উপকার পান ‘গ্রাউন্ডিং’ কৌশলে, যেমন মাথা ঘোরার সময় স্থির কোনো জিনিসের দিকে তাকানো বা দুই পা শক্তভাবে মাটিতে রেখে দেওয়া। স্ক্রিনে বেশি সময় তাকানো এড়িয়ে চললে ভালো, কারণ দ্রুত চলমান ভিজ্যুয়াল মাথা ঘোরার অনুভূতি বাড়াতে পারে।

মানসিক সহায়তাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধু, পরিবার বা কাউন্সেলরের সাথে অভিজ্ঞতার কথা বলা উদ্বেগ কমায়। ভূমিকম্পের মানসিক আঘাত বাস্তব, যদিও কেউ শারীরিকভাবে আহত না-ও হতে পারেন। মানসিক ধাক্কা শরীরের অনুভূতিতে প্রভাব ফেলতে পারে এটি মানতে পারা সুস্থ হওয়ার প্রথম ধাপ। যদি মাথা ঘোরা কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে বা খুব তীব্র হয়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। এতে অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা যেমন ভার্টিগো, কানের সংক্রমণ বা রক্তচাপের সমস্যা, তা যাচাই করা যায়। প্রয়োজনে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বিশেষ ব্যায়াম (ভেস্টিবুলার এক্সারসাইজ) করতে হতে পারে।

সমাজের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সচেতনতা মানুষের ভয় কমায় এবং ভুল তথ্য ছড়ানো ঠেকায়। মানুষ যদি জানে যে ভূমিকম্পের পর মাথা ঘোরা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, তাহলে তারা একা মনে করে না এবং সহজে সাহায্য চাইতে পারে। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকা উচিত, যেন তারা সহজ ভাষায় মানুষকে বিষয়টি বুঝিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেন। স্কুল ও কর্মস্থলেও শান্ত পরিবেশ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সহায়তা এবং মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকলে ভালো।

পোস্ট আর্থকোয়েক ডিজিনেস সিনড্রোম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে দুর্যোগ শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের শরীর ও মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। ভবন মেরামত করা গেলেও মানুষের স্নায়ুতন্ত্র স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। এই অদৃশ্য পরাঘাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া কমিউনিটির স্বাস্থ্যের অংশ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যারা এই সমস্যায় ভুগছেন তাদের জানা উচিত যে তারা একা নন। এসব অনুভূতি স্বাভাবিক এবং সাধারণত সময়ের সাথে কমে যায়। বিশ্রাম, মানসিক সহায়তা এবং বোঝাপড়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্থিরতা ফিরে আসে।

Poster Designer: Summiya Islam Sinthia 
Content Writer: Musabbir Uddin Shovon