জীবনের শেষ দশ দিনের খবর যদি হঠাৎ এক সকালে পেয়ে যাই, পৃথিবীটা কেমন লাগবে? হয়তো প্রথমে শরীর ভারী হয়ে যাবে, নিঃশব্দে বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে পড়বে। মনে হবে, এত বছর ধরে যা করেছি— পড়াশোনা, কাজ, ভালোবাসা, তর্ক, অভিমান— সবই যেন হঠাৎ অর্থহীন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, এক অদ্ভুত শান্তিও আসবে। কারণ, এবার আর কিছু প্রমাণ করার নেই। শুধু বাঁচার আছে, নির্ভেজালভাবে, শেষবারের মতো।
প্রথম দিন আমি নীরব থাকব। কারও সঙ্গে কথা বলব না। সকালবেলা জানালার ধারে বসে রোদ পড়া দেখব, পাখির ডাক শুনব, বাতাসের গন্ধ নেব। এই পৃথিবীর ছোট ছোট জিনিসগুলো—এক কাপ চা, বাতাসের ছোঁয়া, আলো পড়ে থাকা মেঝে— এত সুন্দর, অথচ আমরা প্রতিদিন কেমন নির্লিপ্তভাবে পার করে যাই। সেদিন আমি প্রথমবার সত্যি করে শ্বাস নেব, কোনো তাড়া থাকবে না, কোনো লক্ষ্য থাকবে না—শুধু অনুভব করা থাকবে।
দ্বিতীয় দিনে আমি যাব মায়ের কাছে। মায়ের মুখের বলিরেখাগুলো স্পর্শ করে দেখব, ওগুলোতেই তো আমার জীবনের ইতিহাস লেখা আছে। মা যখন বলবে, “খেয়েছিস?” — আমি বুঝব, পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল ভালোবাসা হলো এই একটিমাত্র প্রশ্ন। বাবার চোখে হয়তো কোনো আড়ষ্টতা, কিন্তু আমি জানি, ভেতরে কত স্নেহ জমে আছে যা তিনি কখনও বলেননি। সেদিন রাতে আমি চুপচাপ মায়ের কোলে মাথা রাখব। পৃথিবীর সব সাফল্য, সব অর্জন, সব অহংকার ওই এক কোলে গলে যাবে।
তৃতীয় দিনে আমি যাব সেই নদীর ধারে, যেখানে ছোটবেলায় কাগজের নৌকা ভাসাতাম। নদী তখনও বয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমন বয়ে যাচ্ছিল আমার শৈশবের দিনে। আমি জলে হাত ডুবিয়ে অনুভব করব, এই জলের মতোই সময় বয়ে গেছে—থেমে থাকেনি এক মুহূর্তও। আমি একমুঠো জল হাতে তুলে বলব, “তুমি যা নিয়ে গেলে, তাতেই তো আমার জীবন।”
চতুর্থ দিনে আমি যাব সেই মানুষদের কাছে, যাদের কষ্ট দিয়েছি। কিছু মানুষকে আলাদা করে ডেকে নেব, কিছুজনকে হয়তো ফোন করব। আমি বলব, “ক্ষমা করো, আমি মানুষ ছিলাম, ভুল করেছি।” হয়তো কেউ বলবে, “ভুলে গেছি অনেক আগেই।” কেউ হয়তো ফোন না তুলবে। কিন্তু তাতে কিছু আসে না। কারণ ক্ষমা তো অন্যের জন্য নয়, নিজের জন্য।
পঞ্চম দিনে আমি হাঁটব শহরের রাস্তায়, একা। কোনো গন্তব্য থাকবে না, কোনো দৌড় থাকবে না। এক টুকরো চায়ের দোকানে বসে অচেনা কারও সঙ্গে গল্প শুরু করব। আমি দেখব, এই পৃথিবীতে অচেনা মানুষই কখনও কখনও সবচেয়ে সত্য কথা বলে দেয়। আমি তাদের হাসি দেখব, কণ্ঠে শুনব জীবনের অনন্ততা। এক রিকশাচালক হয়তো বলবে, “জীবন তো চলে ভাই, থামায় কে?” — আমি মৃদু হেসে বলব, “হ্যাঁ, ঠিক তাই। জীবন চলে।”
ষষ্ঠ দিনে আমি লিখব। অনেক কিছু। নিজের সম্পর্কে, প্রিয়জনদের সম্পর্কে, অপূর্ণ ভালোবাসা, অসমাপ্ত চিঠি—সব। লিখব, কারণ মৃত্যুর আগে কিছু রেখে যাওয়া দরকার—কথা, অনুভব, কিংবা এক ফোঁটা অনুতাপ। আমি লিখব, “মানুষ বাঁচে, কিন্তু খুব কম মানুষ সত্যি করে বাঁচে।”
সপ্তম দিনে আমি চলে যাব পাহাড়ের দিকে। নিঃশব্দ সবুজে বসে আমি নিজেকে শুনব। পৃথিবীর শব্দ তখন যেন মিলিয়ে যাবে। পাখির ডাক, বাতাসের হালকা সোঁ সোঁ আওয়াজ—সব মিলে এক অন্তর্মুখী সঙ্গীত বাজবে ভেতরে। আমি বুঝব, মৃত্যু ভয় নয়, মৃত্যু এক প্রকারের প্রত্যাবর্তন—যেখানে আমরা আবার শূন্যতায় মিশে যাই, সেই চিরন্তন নীরবতায়।
অষ্টম দিনে আমি মিলব তার সঙ্গে, যাকে এক সময় অশেষ ভালোবেসেছিলাম। কথা হবে না বেশি, শুধু চোখে চোখ রাখব। এত বছর পরও চোখের ভাষা অপরিবর্তিত। হয়তো আমরা জানি, আমাদের সময় ফুরিয়েছে, কিন্তু ভালোবাসার কোনো শেষ হয় না। আমি শুধু বলব, “তুমি সুখে থেকো।” সে হয়তো বলবে, “তুমি তো চিরকাল আমার গল্পের ভেতর থাকবে।”
নবম দিনে আমি বন্ধুদের ডাকব। পুরনো দিনের গান গাইব, হাসব, কান্না আসবে, গল্পে ভেসে যাব। কেউ বলবে, “এই তো, এমনভাবে বাঁচা দরকার ছিল সারাজীবন।” হ্যাঁ, সত্যিই, আমরা কখনো বাঁচতে পারি না, যতক্ষণ না জানি সময় সীমিত। সেদিন রাতে আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করব—যদি আবার জন্ম হয়, আমরা প্রতিদিনকে শেষ দিনের মতো বাঁচব।
দশম দিনে ভোরে উঠে আমি সূর্যের আলোয় চোখ রাখব। বাতাসে এক অনির্বচনীয় শান্তি থাকবে। আমার ভিতরে ভয় নেই, শুধু কৃতজ্ঞতা। আমি বলব, “ধন্যবাদ জীবন, তুমি কঠিন ছিলে, কিন্তু সুন্দর।” তারপর চোখ বন্ধ করে হাসব। জানি না এরপর কী আছে—আলো না অন্ধকার, পুনর্জন্ম না বিস্মৃতি—কিন্তু আমি জানি, আমি পূর্ণ।
এই শেষ দশ দিন আমাকে শিখিয়েছে, জীবন মানে সময় নয়, অনুভবের গভীরতা। কত দিন বাঁচি, সেটা নয়—কতটা গভীরভাবে দেখি, শুনি, ভালোবাসি, ক্ষমা করি—সেটাই আসল। মৃত্যু হয়তো শেষ নয়, বরং জীবনের সর্বোচ্চ উপলব্ধি।
