ভোর সকালে পাখির কিচিরমিচির ডাকে সতেরো বছরের রেজা চোখ খোলে। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি ঘড়ি দেখলো সে। নাহ, দেরী হয়নি। রেডি হয়ে রান্নাঘরে গেলো পা টিপে টিপে। একটা পাতিলে কিছুটা বাসি ভাত জলে জবুথবু হয়ে পড়ে আছে। তাকের উপর সাজানো বিস্কিটের প্যাকেটগুলোর দিকে রেজার চোখ গেলো। মামির ভয়ে সেগুলোতে হাত দেবার সাহস হলো না। ঢোক গিলে পান্তা ভাতটুকু নুন মরিচ দিয়ে খেয়ে বেরিয়ে গেলো।ওহ, বলাই হয়নি।একটা কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানির ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করে সে।
অফিস থেকে পার্সেল গুলো বুঝে নিয়ে সাইকেলে চড়ে চড়ে অলিতে-গলিতে ঘুরতে লাগলো সে। আজ অনেক রোদ পড়েছে। রোদে ঠা ঠা দুপুরে সম্পূর্ণ তাপটা শরীরে লাগছে। সতেরো বছরের শরীর এত কষ্ট সইতে পারে না তবুও পেটের দায়ে কাজ করতে হয়। কাজ না করলে মামি খেতে দেবে না, পড়ার টাকাতো দেবেই না। আর সে অনেক দূর পড়তে চায়। জীবনে এত টাকা উপার্জন করতে চায় যেন তার সন্তানকে কখনও ডেলিভারী ম্যান হতে না হয়। রাস্তায় যেতে যেতে তার পদচিহ্নের সাথে সাথে শারীরিক শক্তিও যেনো একটু একটু করে শরীর ছেড়ে পেছনে পড়ে রইছে। কোনভাবে পার্সেলগুলো জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারলেই বাঁচে। সামনে বৈশাখ এর উৎসব, এই সময় ডেলিভারির প্রচণ্ড চাপ থাকে। কারও পার্সেল নিয়ে আবার দু তিন তালায়ও উঠতে হয়। এক সেকেন্ড ও ফুসরতের জো নেই। পার্সেলগুলো দিতে দিতে খেতেও ভুলে গেলো সে।
কাজ করতে করতে খুব ক্ষুধার্ত লাগছে রেজার। কোনরকম নাকে মুখে রুটি কলা গুঁজে সব পার্সেল ডেলিভারি শেষ করলো। ফেরার পথে বসের কল। একটা ঠিকানায় পৌঁছে যেতে হবে এক্ষুণি। একজন ম্যাম কিছু জিনিস দিবেন সেটা আরেক ঠিকানায় দিয়ে আসতে হবে। রেজা ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেলো। একজন আপু বেশ বড়সড় একটা প্যাকেট দিলেন। প্যাকেটের ভেতর কি আছে দেখা না গেলেও এত সুঘ্রাণ বেরোচ্ছে যে বোঝাই যাচ্ছে ভেতরে সুস্বাদু রান্না। বড় মুরগীর রোস্ট, খাসির রেজালা, ডিমের কোরমা, পোলাও, উফফফ্। খাবারের গন্ধে পেটের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। সতেরো বছরের রেজা চুপ করে খাবারের সুবাস গিলতে লাগলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
খাবার গুছিয়ে নিয়ে চললো গন্তব্যে। খাবারগুলোর দিকে বারবার চোখ যেতে লাগলো রেজার। মনে করতে চেষ্টা করলো শেষ কবে ভালো কিছু খেয়েছে সে। মামা মামীর কাছে থাকা রেজা কতদিন ভালো কিছু খায় না। শেষ বার মায়ের হাতে খেয়েছিলো মন ভরে, বছর তিনেক আগে যখন তার বাবা মা বেঁচে ছিলো। না রেজা, এসব ভাবলে হবে না। তোর দায়িত্ব খাবার গুলো সনয়নতো পৌঁছে দেয়া, খাওয়ার চিন্তা করা তো এসময় মহাপাপ। রেজা দ্রুত পা চালিয়ে পৌঁছে গেলো ঠিকানায়। এত দ্রুত চালিয়ে প্রচণ্ড হাঁপিয়ে গিয়েছে সে। পিপাসায় বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। খাবারগুলো হাতে নিয়ে কলিং বেল বাজালো। একজন দরজা খুলে দিতেই রেজা পরিচয় দিলো। খাবারগুলো নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিতে যাবে এমন সময় রেজা বললো, একটু পানি হবে।
বাড়ির কর্তা ভেতরে পানি আনতে গিয়ে খালি হাতে ফেরত এসে বললো, দুঃখিত, পানি মাত্রই শেষ হয়ে গিয়েছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, এখনই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রেজা বললো, আচ্ছা অসুবিধা নেই, আমি তাহলে আসছি। এই বলে সে বেরিয়ে আসলো। প্রচণ্ড রোদে আর পিপাসায় তার অজ্ঞান হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সে তার পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগটা বের করলো, যেটার একপাশে মায়ের পুরোনো একটা ছবি খুব যত্নে রেখে দিয়েছে সে। মায়ের ছবিটায় হাত বুলিয়ে যেতেই চোখটা ছলছল করে উঠলো। সে চোখে পুরো দুনিয়া রোদ আর জলে মিশে ঝাপসা হয়ে গেলো।
ছবির দিকে তাকিয়ে রেজা বলে উঠলো,
খিদে পেলে কেউ তোমার মতো খাইয়ে দেয় না, মা।
মাগো, আমার খুব খিদে পেয়েছে, মা!
সাবিকুন নাহার অন্তু